১
কবিতারা উঠে দাঁড়াতে চায়
তোমার অসুখের বিছানার পাশে
আমার কবিতারা বসে আছে
কোথাও যায়নি ওরা
জানালার চাঁদে হাত বাড়ায়নি ওরা
স্নেহান্ধ পিচ্ছিল কান্না চেপে
সারারাত জেগে জেগে আছে।
কী বলল ডাক্তার?
হয়তো সেরে যাবে
তিনমাস বিশ্রামে তারপর একটু একটু করে
কে দেখবে সংসার? আমরা সবাই হাওয়া খাব?
ছেলেমেয়ে আর শীতের কুয়াশার হাত ধরে
রোদের অপেক্ষা করে করে আমরা কি বিপ্লবী হব?
মৃত্যুকে পুষে পুষে রোজ বড় করি
মৃত্যু কি কোনও দিন আলো হতে পারে?
ডাক্তারের কাছে কোনও সমাধান নেই
শুধু অ্যানাস্থেসিয়া আর ডেটলের গন্ধ ঘরময়
সেলাইন চুপচাপ শরীরে ঢোকে
যন্ত্রণারা উপশম চায় আমার শব্দের কাছে
কবিতারা উঠে দাঁড়াতে চায়
সুসংবাদ এসে যদি দরজা খুলে ডাকে!
২
জানোয়ার
আমরা স্বর্গের দিকে যেতে যেতে দুইপাশে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম
আমরা সবাই দেবতা—চারিপাশে আমাদের শরীরের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছিল
চারিপাশে সবাই আমাদের দেখছিল আর ফুল ছুঁড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিল
আমাদের কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না সেদিকে
হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিলাম স্বর্গযানে
দুইপাশে মরচেধরা প্রাণী—ক্ষুধার্ত—ভঙ্গুর—তৃষ্ণার্ত—হাহাকারপ্রিয়...
দুইপাশে কসাইয়ের দোকান—
নিরন্তর ছুরি শান দেওয়ার শব্দ
নিরন্তর দুর্বোধ্য ভাষার চিৎকার...
আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা
স্বর্গে যেতে যেতে দেখছি এসব;
আমাদের গাড়ির চালক জানাল:
এরা সবাই বিভিন্ন জাতের প্রাণী—
পৃথিবীতে এদের জানোয়ার নামে ডাকা হয়!
৩
দুপুরের ডাকঘর
দুপুর এসেছে,একটু পর চলে যাবে
তাকে কিছুই বলার নেই
অনেক মৃত সকাল, শিশির ভেজা ভোর
স্মৃতির আলোয় পড়ে আছে
পাখিদের কলতান উড়ছে কোথাও
কোথাও বিগতা কুমারী শিস দেয় আজও
শরতের শালুক ফোটা দিঘি আর নেই
দিঘির বকেরা সব মৃত! মাছগুলি চলে গেছে অন্যকোনও সমুদ্রের দিকে....
এখন হৃদয় পেতে ছায়া খোঁজা দিন
বিশ্রামে নীরব হয়ে থাকা
মাটি ফাটা তাপে বয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস
শীত আর কুয়াশায় লেখা জীবনের শেষ চিঠি
নিয়ে এসেছে দুপুরের ম্লান ডাকঘর
৪
স্পর্শ
এই হাত, আমারই হাত, আমিই স্পর্শ করি
সমস্ত শরীর জুড়ে এখনও সেই স্পর্শের শিহরণ পাই
যে আলো নিভে গেছে বহুদিন
এখনও তার উজ্জ্বলতা আছে
এখনও অক্ষরগুলি পড়ে নিতে পারি
হৃদয় পাথর হয়ে গেছে, যে শোকে পাথর হয়
সব বেদনার অশ্রুগুলি
পথও হারায় পথে
ঠিকানাও বদল হয় অন্য কোনও ঠিকানায়
একটা শূন্যের মতো পৃথিবী গড়াতে গড়াতে
দিনরাত্রি প্রসব করে শুধু
ফেল করা ছাত্রের মতো আমরা শুধু অংকে শূন্য পাই
ঘর বানাতে বানাতে প্রতিদিন ঘর ভেঙে ফেলি
প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতে প্রতিদিন ডাকি অন্ধকার
স্মৃতির কাঁচ মুছতে মুছতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়
শুধু হাতখানি স্পর্শ ধরে রাখে
যে স্পর্শ তার একান্ত ঈশ্বরীর...
৫
সোনার মঙ্গলকাব্য
রাতদিন সোনার হরিণ শিকার করি
আর হরিণের মাংস আনি ঘরে
ফুল্লরা রান্না করে দেয়
আমি ও আমার সন্তান মিলে খাই
সোনার সংসারে আমরাও সোনার মানুষ
রোদ্দুরে চিকচিক করে শরীর আমাদের
অরণ্য প্রত্যহ হরিণ প্রসব করে
সোনার তীর-ধনুক হাতে যখন দাঁড়াই
আমাদের গল্পগুলি পাখা মেলে ওড়ে
গল্পগুলি খুঁজে ফেরে মুকুন্দরামের ঘর
কত যুগ পার হচ্ছে, সোনার হরিণ হচ্ছে মায়া
আমরাও বদলে যাচ্ছি লোহায় পেতলে
ফুল্লরাও পাল্টে হচ্ছে ফেলু-ফেলানিতে
তীর-ধনুকগুলি এখন বন্দুক-পিস্তল
অরণ্য নগর-রাষ্ট্র সমূহ শিকারভূমি এই সভ্যতার
সন্তান-সন্ততি মিলে আমরা সব মরীচিকা খাই
***নব্বই দশকের কবি ও গদ্যকার। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'কোথায় পা রাখি' (১৯৯৪) ।কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ :বৃত্তের ভেতরে জল, জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা, উন্মাদ বিকেলের জংশন, স্তব্ধতার ভেতর এক নিরুত্তর হাসি, নির্ঘুমের হ্রস্ব ধ্বনি, আকাঙ্ক্ষার ঘরের জানালা, সভ্যতা কাঁপে এক বিস্ময়ের জ্বরে ইত্যাদি । পুরস্কার পেয়েছেন :কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার, দৌড় সাহিত্য পুরস্কার, নতুনগতি সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি ।ঠিকানা :
তৈমুর খান, রামরামপুর (শান্তিপাড়া), ডাকঘর :রামপুরহাট, জেলা বীরভূম, পিন কোড ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ ।ফোন নম্বর ৯৩৩২৯৯১২৫০
No comments:
Post a Comment