ঊশ্রী মন্ডলের গুচ্ছ কবিতা --
আমার সন্তান
ছিলাম বাসে বসে বাঁশকোভার টোল প্লাজায়..
কিছু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অতিষ্ঠ করছিলো বেজায়,
বিকট সাজে নানান অঙ্গভঙ্গি সহকারে জানি না.. চোখে মুখে কোন প্রতিবাদকে ছেপে উল্লাসে মত্ত ?
জবরদস্তি পয়সা চাইছে,যেন তারা রণমত্ত..|
হঠাৎ ওদের মাঝে, একটা চেনামুখ দেখলাম..
সে যে আমার হারিয়ে যাওয়া সন্তান কলাম,
ডেকে উঠলাম, " ওরে খোকা আমায় চিনতে পারছিস ?
আমি তোর মা, আয় বাছা এ বুকে ফিরে আয় " ;
চকিতে বেদনা মাখানো চোখে দেখলো আমায়..|
বলে সে, " আর পিছু হতে ডেকোনা আমায়..
এগিয়ে গেছি অনেকদূর ফেরারপথ নেই, আমি অনুপায়,
যখন ছিলো প্রয়োজন সমাজ করলো না গ্রহণ ;
ধিক্কারিল, উপহাস ও তিরস্কারে নিমজ্জিত করলো..
বুঝলোনা তারা আমার শারীরিক ও মানসিক অসুবিধাগুলো..|"
বললেম, " ওরে অবুঝ আমি তোর মা..
ওরে আমার পরমানন্দের নাড়ি ছেঁড়া পৃথগাত্মা ,
দিয়েছিলাম জন্ম দশমাস দশদিন গর্ভে করে ধারণ ;
যে রূপে জন্মেছিস তাতে তোর কী'দোষ..
আমাতেই অবস্থান করেছিলো ত্রুটিপূর্ণ দেহকোষ..l
আমি তোকে পেয়ে হয়েছিলাম -সন্তানসুখে সন্তুষ্ট,
একটু না হয়,ছিলিস শারীরিক ভাবে অপরিপুষ্ট ;
অথচ তুই ছিলি গুণে বুদ্ধিতে শক্তিতে সমৃদ্ধ,
সমাজ তোকে কী পালতো ? আমিই তো পালছিলাম..
শুধু আমি একাই সন্তান হারানোর কান্না কাঁদছিলাম..|"
" আজ ভালো আছিস তো খোকা আমার..
নতুনসমাজ আর গুরুমা যত্ন করেতো ? হোসনিতো চূরমার ?
কী পেলি হোথায়, দিনগুজরানের জন্য মানুষের ধিক্কার ;
উপহাসের পাত্র হয়ে হলি অত্যন্ত নগন্য..
এখনো কেন হয়ে আছিস অবাস্তবতায় সাগরে অচৈতন্য..? "
"এখনও বেশী দেরী হয়নি প্রিয় কলাম...
এ মায়ের দুয়ার বরাবরের জন্য খোলা রবে বললাম,
আসিস যদি ফিরে,আবার তোরে -সংরক্ষণ দেবো ;
তোরদিকে তুলতে দেবোনা,অঙ্গুলি সমাজকে-কথা দিলাম ,
নিশ্চই,মানুষের মতো মানুষ হবি আমি কইলাম..|"
সেই সময় আর এখন
মনে পড়ে সেই দিনগুলো - সাল উনিশশো ছিয়াত্তর..
Q'ব্লকের তিনতলায় থাকতাম,
জানলা দিয়ে দূরকে দেখতাম,
L'ব্লকের কালভার্ট, তেতুলতলার মোড় ;
দাদা আমাদের পরিবারের গার্জেন এখন-
বাবার মৃত্যুর পর,
একরাশ দারিদ্রতা সংসারে ছেয়েছিল..
তবুও সুখেই ছিলাম.. |
দান করা পোষাক..
সেলাই করা জুতো..
জরাজীর্ণ স্কুলব্যাগ, আধপেটা খাবার নিত্যসঙ্গী,
লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম না,
দুস্টুমি বুদ্ধি কিন্তু প্রচুর ছিলো,
চাহিদা মতো সামগ্রী পেতাম না ;
তাও পরমানন্দে তিতলির মতোই..
ডানা মেলে উড়তাম..|
সবুজসাথী সব পেয়েছির আসরে খেলতাম,
নানান করসৎ শিখতাম,
লোকনৃত্য, প্যারেট পিটি ব্যায়াম -
নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করতাম,
নিত্যনৈমিত্তিক একই অনুশীলন ভালো লাগতোনা,
ছুটির দিনের সকালে...
বেরিয়ে পড়তাম সদলবলে সুদূরে ;
সোনালি রঙের ধানের খেতে..|
কিংবা ঐ গ্রাফাইডের নির্জন মাঠে...
যেখানে এখনও একটা দেওয়াল দাঁড়িয়ে,
শুনেছি সিপাইরা বন্দুক..
নিয়ে অনুশীলন করতো প্রতিনিয়ত,
মনে মনে আমিও সিপাই হতাম..
ঠাই ঠাই শব্দে,
বন্দুক চালাতাম, একাগ্র চিত্তে ;
অর্জুনের মতোই হতাম লক্ষ্যভেদি..|
সময়ের কাঁধে ভর করে একসময়..
বড়ো হয়ে গেলাম,
দেখলাম কি ভাবে কাউকে না জানিয়েই..
মা হাসিমুখে সব সয়ে,
আমাদের মানুষ করে তুলেছেন,
নিজে ছিলেন দুশ্চিন্তায় আমরা ছিলাম আনন্দে,
ফিরেও চোখের জল মুছিনি ;
নিজসুখে যে মত্ত ছিলাম..|
এবার বিশ্রাম দিতে হবে..
অনেক করেছে আমার জন্য এতদিন,
দাঁড়াতে হবে পাশে খুঁটিরমতো..
লহেরাবো সুখের পতাকা এইদিন,
কর্মের বাজারে এখন চলেছে দুর্দিন,
ডিগ্রি আছে চাকরি নাই,
হবে কি উপায় ভেবেভেবে হলাম সারা ;
একটা চাকরি চাই অবশ্যই..|
ঘুরতে ঘুরতে হয়ে পড়েছি ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন,
প্রতিশ্রুতি ঢালাও, দিনশেষে ঠুঁটো জগন্নাথ,
এখনও চোখে ভাসে স্বপ্ন রঙিন,
এ হৃদয়ে জাগে প্রেম..
তারে দেখছিলাম ট্রেনের কামরায়,
বাইরেকে দেখছিলো আপনমনে..
বললাম, "বইটা দেবেন,"
অম্লান বদনে সে তা দিয়েছিলো |
ক্রমেক্রমে হলো অনেক কথা,
অনেকবার হলো দেখা শোনা,
কিন্তু আজও মনের কথাটা বলা হলোনা ;
ভালোবাসি কথাটা শোনার অপেক্ষায় রয়ে গেলাম..
শীত পেরিয়ে বসন্ত এসেগেলো,
জানিনা কখন হারিয়ে গেলে ;
এখন আমি একা ভীষণ..
জানিনা কি হয়েছিল আমার অপরাধ..|
এখন বয়ভারে আমি পরিপূর্ণ,
কিন্তু ফিরে পেতেচাই বচপন,
তোমার নীরব ভালোবাসা ;
বলতাম ভালো আছো তো?
জানি- এ আশা পূর্ণ হবেনা,
যা চলেযায় -তা আর ফেরেনা,
স্মৃতিগুলি শুধুই বয়ে বেড়াই..
আর এবোঝা বইতে পারিনা..|
পরিজ্ঞান
শোন্ বাবা,আমি তোর মা -দিলাম অভিজ্ঞতা,
ভালো মন্দ,সবকিছুই- যেগুলি শুরু থেকে আজ পযন্ত অর্জেছি ;
জানিস,মনের আনন্দে উড়তাম দুডানা মেলে-সেই বেপরোয়া আনন্দও তোকে দিলাম,
একটা সতর্ক বার্তাও সাথে দিলাম..
ভেবে চিন্তে দেখে শুনে উড়িস কেমন,
এতে তুই কোনোদিনই হারবি না ; আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম l
নে অঞ্জলি ভরে, এগুলি এখন সব তোরই..
দিলাম,আমারই আঁকা ছবি -আমারই পটভূমিকার,
দিলাম,আমার সমস্ত রঙ -যা উজ্জ্বল রঙে রঙিন ;
তুইও আঁকিস,তোরই ছবি - তোরই ইজেলে অবলীলায় l
আমার ভালোবাসা, যা ছিলো ভুলে ভরা - তাও তোকে দিলাম,
ভালোবাসিস ,ভুল করবি না- কথা দে আমায় ;
আমি নারী, বোধহয় কমনীয়তা ছিলো প্রবল,
তাই বারংবার হয়েছি- অবহেলিত ;
কিন্তু তুই তো পুরুষ, বুক ভরা আছে দৃঢ়তা - তা নিয়ে বিশ্বকে করিস আন্দোলিত l
জানিস, কিছু অভিমান চুপিচুপি এ হৃদয়ে -বাসা বেঁধে বসে আছে..
তা - দেবোনা,
সে গুলি ওখানেই থাক,
যখন চলে যাবো,আমার সাথে- তারাও যাবে ;
এ গুলি যে একান্তই আপনার |
এই নে,আমার ভাবনায় ভরা- কবিতার খাতা , যা বড়োই প্রিয়..
তুই তোর ভাবনাকেও লিখিস, এরই খালি পাতায়,
তোর পরবর্তী দেখবে আমাদের..
আমরা ছিলাম, একই নীল আকাশের তলে - তখন ও যেমনে থাকবে ;
আমি নিশ্চই জানি,বাকি খালি পাতায় - সেও কিছু লিখবে ;
আমাদেরই মতো কিছু পরিজ্ঞান তারই কবিতায় l
চিঙ্গারী
নিজেকে নিঃশেষে,পড়ছি ছাই হয়ে ঝরে ঝরে ,
অদৃশ্যে সুগন্ধি হয়ে ভাসছি ,প্রতিনিয়ত তোমাকেই ছুঁয়ে যাই,
কেন হচ্ছি অবহেলার শিকার ?
বাহিরের আকর্ষণে তুমি আকর্ষিত, মিথ্যের চাকচিক্যে সুখকে খোঁজো ,
কেন বুঝলে না আমার এই প্রণয় ?
এই কী আমার নিয়তি,একাকী বসে ভাবি ঘরের কোণায় ,
বড়ো জ্বালা এ মনে, জুড়াতে চাই, জুড়াবো কোথায় ? প্রভু পথ দেখাও ;
আমিও তো হাসতে চাই,উচ্চস্বরে গাইতে চাই..
রইবো না একলাই গৃহকোণে ঐ নীলিমায় উড়তে চাই..|
বেশ ছিলাম, আপনমনে চঞ্চল হরিণীর ন্যায়
কানন মাঝারে,
এলে তুমি শিকারীর বেশ ধরে,
আমি ছিলাম, শুধুই শিকার ;
সহজ সরল আমি বুঝিনি ছলনা,তোমারই
বিছানো চারায় (যাছিলো শুধুই ফাঁদ )অনায়েসে বুদ্ধিহীনের মতো ধরা পড়লাম , পরম তৃপ্তিতে ;
এরপরেই বুঝলাম, সম্মুখে যে দাঁড়িয়ে আমার সর্বনাশ..l
বড়োই বোকা আমি,ছিলো না -মোটেই জ্ঞান গর্মি,
কিন্তু তুমি জানো না..
ছাইয়ের মধ্যেই রয়েছে ধিকি ধিকি চিঙ্গারী ;
ছারখার করে দিতে পারি সুখের স্বর্গ একলহমায়..l
অনুপ্রেরণার ভূমি
চাই বিখ্যাত ব্যক্তির মতো সাফল্যের হাওয়ায় ভাসতে ,
তাই খুব করছি ক্লান্তিহীন শ্রম-গতানুগতায় অস্তেব্যস্তে ,
আজও পেলাম না কোনো লাভ..
পরিশেষে পেলাম আজ -আভাস ;
অন্যের মতো নয়- বরং আমি হবো আমার মতো অনায়াস..|
পাল্লায় নামলাম নিজের দক্ষতা নিয়ে,
দোষ নিয়ে নয় গুনকে সঙ্গে লয়ে..|
লাভ নেই আগের অধ্যায় বারবার শুধু পড়ে,
শেখার আশায় পরের খন্ডে - যেতে হবে সরে,
নতুন দরজা খুলতে পারি..
ভাসতে পারি নতুনের খোঁজে ;
সামনে দেখি অগ্রে চলার অনুপ্রেরণার ভূমি দিচ্ছে আওয়াজ..|
এ পরান ছাড়লো সকল লাজ,
গলাখুলে গাইছি গান উচ্চস্বরে আজ..|
একতার গান
পুরোনো উপনেত্রকে নতুনে পাল্টিয়ে নিলাম,
ঐ চড়া রোদ্দুরকে রাখলাম আড়ালে কালো চশমায়,
চোখে শান্তি এলো কিন্তু রঙগুলো হারালাম,
অশ্রু পড়ে ছলকে ছলকে বেদনায়..|
রঙহীনতায় ব্যক্ত করি সংজ্ঞা রক্তিমের,
নিজের এই অক্ষমতাকে অতি নিপুণতা সাথে লুকাই,
মন ভালো নেই আজ আমার ব্রহ্মের,
শুধু নিজেকে আজ নিজেই ঠকাই..|
ওহে পৃথ্বী ভালো আছো তো ?
নাকি আমারই মতো চোখে ঠুলি এঁটে নিয়েছো ?
দেখো লতপত ঝান্ডা গাইছে একতারগান ইচ্ছামতো
শুনতে কী পাচ্ছ.. বলি শুনছো..
মেঘে ঢাকা শব্দ
ছিলো,ঐ অম্বরের মুখভার - কটাদিন ধরেই..
একবার হাসে,আবার বিলাপে ভাসে,মহুর্তের মধ্যেই,
ওর কান্নায়,আমার ভাবনাগুলোও..
ভিজে গিয়েছিলো - ছিলাম নরক যন্ত্রণায় ;
ঘরের চারিদিকে দড়ি টাঙিয়ে..
তাঁদের,শুকাচ্ছিলাম আমি - হয়ে অনুপায় |
পাখার ভনভনে হাওয়ায় শুকোচ্ছিলো...
কিন্তু কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে গন্ধ বেরোচ্ছিলো,
সইতে পারছিলাম না..
বইতেও পারছিলাম না ;
উপায়ের,বিকল্প গুলির -অনুসন্ধানে ছিলাম তাই..|
আজ রোদ উঠেছে সকাল থেকেই..
মেঘের কয়েদ হতে,রূর্যকিরণ হয়েছে উচ্ছেদ, অবশেষেই ,
ঘরে টাঙানো,ক্লেদিত চিন্তনগুলো..
বাইরে মেলে দিলাম - যা'ছিলো চুপসানো ;
দেখি শব্দগুলো আদ্র্রতা থেকে..
মুক্তিতে,খিলখিলিয়ে হাসছে - যা মন জুড়ানো.. l
বিহঙ্গের মতো মুক্ত ডানায়..
অক্ষরেরা উড়ছিলো উল্লাসে সৃষ্টি সুখের কামনায়,
আমি পুঙতি ভরছিলাম..
আমি কল্পনাকে আঁকছিলাম,
হারিয়ে,খুঁজে পেলাম - দিয়ে শত্রুর মুখেছাই... l
গুরু গুরু গর্জনে কেগো হেঁকে যায়
গুরু গুরু গর্জনে, কেগো হেঁকে যায় ?
সাবধান, সাবধান উচ্চস্বরে জানায়,
চারদিশা কম্পিত নাও বিধান যা মানায় ;
কালো মেঘে বিজুড়ি চমকে..
গুরু গুরু মাদল বাজে চর্তুদিকে,
খ্যাপা নাচে খেপামিতে লয়ে সৃষ্টিকে ;
কে হাসে অট্টনাদে ?
গুরু গুরু গর্জনে, কেগো হেঁকে যায়..?
শুনি ঐ শুকনো পাতার কিঙ্কিনী..
কুলায় ফেরা বিহগের কলধ্বনি,
অস্তগামীর অশ্বের হ্রেষা ধ্বনি ;
দামাল ঝঞ্ঝা শান্ত হ এবার ..
মুছিস না পথ চিহ্ন তার ,
কৃষ্টি হবে অকারণ জটিলতার ;
বিনতি করি ওরে সর্বনাশা l
গুরু গুরু গর্জনে, কেগো হেঁকে যায়..?
কারা যেন করছে করায়ত্ব ঐ শুন্যতারে...
মিশমিশে কালোয় ছাওয়া, আঁধারে
লুকোলো তারারা কার অঞ্চলে চুপিসারে ?
ফাটল বাদল প্রবলে উদ্দামে উল্লাসে
ঝরঝরিয়ে পরে ধরায় অল্প প্রয়াসে
ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাওয়াগুলি অনায়াসে
জানিনা কোন সুদূরে ?
গুরু গুরু গর্জনে, কেগো হেঁকে যায়...?
ওরে কেন পরে আছিস ঘরের কোণে ভয়ে ত্রাসে..
বেরিয়ে পড় ভিজতে নব বারিসে,
নিজেকে নূতন করে গড় সাহসে ;
কেন ভাবছিস অকারণে এতো..
খুলে ফেল বন্ধ দুয়ার যত,
ভিজুক না মনের আসবাবপত্র ;
মুক্ত হউক নিয়মকানুন |
গুরু গুরু গর্জনে, কেগো হেঁকে যায়...?
এবার ঠোঁটের গোড়ায় হাসি ছড়িয়ে পড়ুক...
চোখ ইতিউতি তারে খুঁজুক,
মিলনের আশে তারা মিলুক ;
মিলেমিশে গড়ুক নতুন সংরচনা..
করজোড়ে নতমস্তকে করুক অর্চনা,
শুরু হউক অগ্রের সূচনা ;
জন্ম নিক আরেক নবজাতক |
গুরু গুরু গর্জনে, কেগো হেঁকে যায়..?
No comments:
Post a Comment